দেশান্তরি হওয়ার নানা কারণ থাকে৷ আমরা কেনিয়া যাই জঙ্গল আর বন্যপ্রাণীর সন্ধানে৷ মিশর খোঁজ দেয় প্রাচীন সভ্যতার ৷ সুইজারল্যান্ড মুগ্ধ করে প্রাকৃতিক শোভায় ৷ উন্নত নাগরিক জীবনের চিত্র আঁকা ইউরোপ বা আমেরিকার পথে প্রান্তরে৷ ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশ আমাকে টানে মূলত তিনটি কারণে-পল্লীপ্রকৃতি, মানুষের আন্তরিকতা আর (তৃতীয় কারণটি সর্বাধিক আকর্ষণীয়) সে দেশের নানান সুস্বাদু ভোজন সামগ্রী৷
বহুবার গিয়েছি নানা অঞ্চলে৷ রসনা হয়েছে তৃপ্ত৷ তবে গল্পটা শুরু করি রাজধানী ঢাকা থেকেই৷ বছর দু-এক আগে একবার ঢাকা ভ্রমণে নিউমার্কেটের প্রবেশপথে কানে এল, ‘আরে আপা আইস্যা পড়ছে৷ ওনারে বসা, পাখা দে, মেন্যু দেখা৷’ অপরিচিত স্বরে এহেন আমন্ত্রণ বাংলাদেশেই সম্ভব৷
ঢাকা শহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকেশ্বরী মন্দির, সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি দর্শনীয় স্থানসমূহ সবাই দেখেন৷ কিন্তু সাত মসজিদ রোডের বিক্রমপুর পিঠাঘরের সূর্যমুখী পিঠা, নকশি পিঠা, মুগ-পাকন (মুগের ডাল দিয়ে প্রস্তুত) পিঠা না চাখলে ভ্রমণ অধরা৷ মিষ্টি সুন্দরীদের নাম শুনলেই জিভে প্রেম জাগে৷ শুনেই দেখুন একবার৷ হাবসী-হালুয়া, ক্রিম জাম, পটলভোগ, রসমাধুরী৷ আহা! যেমন নয়নসুখকারী তেমনই রসনা বিনোদিনী৷
রক্তে শর্করা চলুন এগোনো যাক সাত মসজিদ রোড ধরে৷ থ্রি-স্টার রেঁস্তোরা৷ চওড়া সিঁড়ি৷ বাঁয়ে বেকারি। ডান হাতে কাবাব ঘর৷ দোতলা বা তিনতলায় পৌঁছে যান৷ বিখ্যাত বিরিয়ানি আর চিকেন রোস্ট আপনার অপেক্ষায়৷ খাবার পরে বোরহানি এক গ্লাস৷ দই, বিট নুন, পুদিনা, লঙ্কার উপাদানে প্রস্তুত হজম সহায়ক পানীয়৷ বিরিয়ানি না-পছন্দ৷ মাছে ভাতে বাঙালি হয়ে যান৷
ধানমন্ডির টেকআউট৷ বার্গারটি বেশ ভালো৷ গুলশানের রাধুঁনী৷ বিরিয়ানির শাহেনশাহ। পুরান ঢাকার নীরব হোটেলের ভর্তা ভাজি নাম করা৷ পুরোনো পল্টনের কস্তুরি বাংলাদেশি পদে লা-জবাব৷ আবুল হাসনাত রোডের ‘কলকাতা কাচ্চি ঘর’ বিরিয়ানিতে দড়৷ পুরান ঢাকার বাখরখানিতে পৌঁছে যান চা-নাশতার জন্য৷ উত্তরার ‘একুশে রেস্তোরাঁ’, ‘ঘরোয়া রেস্তোরাঁ’ ভুনা খিচুড়িতে পয়লা নম্বর৷
বেকারিতে ‘আনন্দ’, ‘ইউসুফ’, ‘ডিসেন্ট’৷ পূর্ণিমার জিলাপি। অনামীর খোঁজে পথে নেমে আলাপ হলো ঢাকাইয়া ফুচকার থেকে৷ ধানমন্ডির পাঁচ নম্বর রাস্তা, গুলশানের কুমুদিনী বা বসুন্ধরার সামনের খোঁজ করুন৷ পেয়ে যাবেন৷ মৌচাক মার্কেটের ‘চটপটি’, বিউটির শরবত আর লাচ্ছি৷
ঢাকা ছেড়ে পশ্চিমদিকে যাই৷ ধামরাই পেছনে ফেলে চলেছি এন-৫ ধরে৷ মানিকগঞ্জ হয়ে পাটুরিয়ার দিকে৷ গড়াই নদী পার হলাম৷ মাইলফলক বলছে আরিচাঘাট ১৮ কিলোমিটার৷ মন উচাটন পদ্মার সাক্ষাতের জন্য৷ গোয়ালন্দ আসতেই জিভে জল৷ স্টিমারের তেতলা বা চারতলায় চলমান রেস্তোরাঁয় ভাত, ডাল, দু পিচ ইলিশ৷ সঙ্গে অফুরান পেঁয়াজ আর লঙ্কা৷
গন্তব্য নাটোর৷ বিখ্যাত তিনজনের কারণে৷ প্রথম, অর্দ্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানী৷ দ্বিতীয়, জীবনানন্দের মানসী বনলতা সেন৷ শেষ কারণ, কাঁচাগোল্লা৷ ‘মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারে’ কাঁচাগোল্লা খুঁজতে গিয়ে ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’ দশা৷ রূপের হাট সেখানে৷ দুধ ফুলকি, ছানাবড়া, দুধ মালাই, ক্ষীরভোগ, অবাক সন্দেশ, রাবকশাই, পানিতুয়া, ক্রিমটোস্ট৷ কাকে ছেড়ে কাকে খাই৷
গৌরগোপাল চন্দ্র ঘোষ৷ ভারত থেকে গিয়ে আস্তানা গাড়েন বগুড়ার শেরপুরে৷ নিকটে প্রবহমান করতোয়া৷ জাত গোয়ালা গৌরগোপাল দই বানিয়ে বেচতে যেতেন শহরে৷ অল্পেই জনপ্রিয়৷ ক্রমশ সুনাম বৃদ্ধি৷ বগুড়ার সাতমাথা মোড়ে জন্ম নেয় গৌরগোপাল দইঘর৷
মহাস্থানগড়ের পাশাপাশি সাতমাথা মোড় অবশ্য দ্রষ্টব্য৷ পাতলা মাটির পাতিলে বসানো ‘চিনি পাতা দই’৷ মিষ্টি, টক, সাদা, ঘোল – কত রূপ৷ মূল্যে এবং কৌলীন্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাহি দই৷
বগুড়া পড়ে থাকে পেছনে। পৌঁছাই এলেঙ্গা৷ টাঙ্গাইলের মফস্বল। এখানকার শাড়ি বঙ্গ নারীর স্বপ্ন সহচরী৷ কিন্তু মন যে পোড়াবাড়ির চমচমের প্রতীক্ষায়। ইতিহাস খুঁজি৷ কানে আসে পোড়াবাড়ি গ্রামের নাম৷ টাঙ্গাইলের চার কিলোমিটার পশ্চিমে৷ জনৈক মিষ্টি ব্যবসায়ীর বসত বাটিটি আগুনের গ্রাসে যাওয়াতে এই নামকরণ৷ প্রথম ময়রা দশরথ৷ বর্তমানে পাল ও ঘোষেরা এই ব্যবসায়ে যুক্ত৷
অতীতে ধলেশ্বরীর লঞ্চঘাটায় ভিড়ত নানান জলযান৷ বাণিজ্য চলতো পুরোদমে৷ চমচমের রমরমা সেই সময় থেকে৷ ইটরঙা এই বস্তুতে কামড় দিলে বিনা আয়াসে অমৃতের স্বাদ পাওয়া যায়৷ কোনো এক রহস্যময় অনুপাতে মেশে ধলেশ্বরীর জল আর গাভির ঘন দুধ৷ সেই অপার্থিব মিশেলের গর্ভ থেকে জন্ম নেয় পোড়াবাড়ির চমচম৷
মুক্তাগাছার মণ্ডা খেয়ে ‘চায়ের দেশ’ সিলেট পৌঁছাই৷ চায়ের গ্লাসে রামধনু দেখতে হলে যেতে হবে শ্রীমঙ্গলের নীলকন্ঠে৷ কাচের গ্লাসে ‘সেভেন লেয়ার্ড টি’৷ লেয়ার প্রতি দশ টাকা মূল্য৷ দর্শনেই নেশা৷
চায়ের গ্লাসে তুফান তোলা কাব্যকথার জনক রমেশ রাম গৌর৷ তারই আবিষ্কার সাতরঙা চা৷ তিন রকম কালো চায়ের সঙ্গে ভিন্ন গোত্রীয় সবুজ চা, গাঢ় দুধ আর নানান সুগন্ধী মসলার পরতে তৈরি৷ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে লন্ডনের বাংলা কাগজেও সুখ্যাতি তার৷ সর্বোচ্চ স্তরে দারুচিনি, ষষ্ঠ স্তরে লেবু, চতুর্থ স্তরে কালো চায়ের সঙ্গে ঘন দুধ, সর্বনিম্ন স্তরে সবুজ চায়ের সঙ্গে লবঙ্গের মিশেল৷ বাকিটা অধরা মাধুরী৷
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শহরের কেন্দ্রস্থলে দুই যুযুধান রেস্তোরাঁ ‘ভোজন আড্ডা’ আর ‘কুটুমবাড়ি’৷ চমৎকার অন্দরসজ্জা এবং পদ৷ আলাপ হল ‘তেলাপিয়ার রস মাধুরী’র সঙ্গে৷ নদী নয়, হবিগঞ্জের হাওর এই মৎসের উৎস৷
সুরমা নদীর পাড়ে সিলেট৷ সীমান্ত ভ্রমণস্থান জাফলং৷ সেখানকার ‘ক্ষুধা’ রেস্তোরাঁর হাঁসের মাংস চিরস্থায়ী সিলমোহর ফেলবে রসনায়৷ সিলেট ও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ভর্তার কথা এখনও বলা হয়নি৷ শিম, বেগুন, টমেটো, টাকিন মাছ থেকে শুঁটকি। সবকিছুর ভর্তা বানাতে ওস্তাদ এই দুই অঞ্চল৷ কক্সবাজারের কাশবন, ঝাউবন, পৌসি প্রভৃতি রেস্তোরাঁগুলোর শাক থেকে শুরু করে নানান মাছের ভর্তার স্বাদ অনবদ্য৷
বান্দরবানের স্থানীয়দের রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায় ‘খচে’, ‘মুন্ডি’ নামের বিদেশি পদ৷ যেমন ঝাল তেমনই শুঁটকির মিশেল৷ রাঙামাটির কাপ্তাই লেকের বুকে জেগে থাকা একরত্তি দ্বীপের চ্যাং পাই রেস্তোরাঁয় আছে ‘ব্যাম্বু চিকেন’৷ ফাঁপা বাঁশে মসলা মাখানো মুরগি ভরে, ময়দা দিয়ে মুখ বন্ধ করে কয়লার আঁচে দগ্ধ৷
কুমিল্লার ‘রসমালাই’, চাঁদপুরের ইলিশ, বরিশালের বালাম চাল, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, যশোরের জামতলার মিষ্টি, নলেন গুড় আর কই৷ সাতক্ষীরার গলদা চিংড়ি৷ কত বলব আর৷ ভোজন বিলাসীর পরিক্রমা চলতেই থাকে৷
শ্রীমা সেন মুখোপাধ্যায়:
কলকাতায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা৷ ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং উচ্চতর পাঠ শেষে নামী সংস্থায় দীর্ঘ ১৮ বছরের কর্মজীবন কাটিয়ে বর্তমানে পারিবারিক ভ্রমণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত৷ ভ্রমণ লেখা শুরু ২০০৪ সাল থেকে৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রায় সমস্ত বাংলা পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে৷