Skip to content Skip to footer

সেনেকাদের সালুবিরার গল্প

অনেক আগে আকাশের পৃথিবী ছিলো। সেখানে গাছগুলো বাতাসে জন্মাতো। ছিল এক দম্পতি। নারীটি মা হতে যাচ্ছে, প্রতিদিন সে নতুন কিছুর জন্য বায়না ধরে। স্বামী বেচারাকে নিত্য নতুন জিনিসের জন্য এখানে সেখানে যেতে হয়। আকাশে আর কোথায় পাবে অতকিছু। একদিন শখ হলো গাছের গুড়ির নিচটা দেখার। গাছগুলোর শেকড়ও ছিলো বাতাসেরই ভেতর। অদেখা বলেই কিনা নারীর মনে হলো, গুড়ির ভেতর রহস্য টানছে। নারীর আব্দারে পুরুষ বিশাল এক গাছ ভাঙলো। নারী দেখলো, গুড়ির ভেতর দিয়ে তো আকাশ দেখা যায় না! হাত বাড়ালো তারপর কী এক আকর্ষণে পা বাড়ালো। সামলাতে না পেরে চলে গেলো ভেতরে। বাতাসের ভেতর জন্মানো গাছের জন্মমূল দিয়ে পিছলে যেতে যেতে সেই নারী অনেক বছর ধরে নিচে নামতে নামতে হঠাৎ দেখলো সামান্য আলো। তারপরই পড়লো অন্য এক জায়গায়। এখানে নীল জল, গাছের পাতা সবুজ। গড়িয়ে প্রায় পানির ভেতর যাবার পর টের পেলো, ভাসছে শক্ত খোলসের উল্টো পিঠে। এটা ছিলো একটা বিশাল কচ্ছপ। পৃথিবীতে মানুষের জন্ম নিয়ে এটা নাকি যুক্তরাষ্ট্রের সেনেকা আদিবাসীদের পৌরাণিক গল্প। সেনেকা নেটিভ আমেরিকানদের এক গোত্র যাদের রেড ইন্ডিয়ান নাম দিয়েছিলেন কলম্বাস।
গল্প শুনতে শুনতে ট্রেইলের ভেতরে প্রায় এক মাইল হেঁটে এসেছি আমি আর ‘কাইওনতাকো’। তাকো আমাদের ট্যুর সুপারভাইজার ‘কেন’ এর বন্ধু। তাকো এখানকার সামান্য ক’জন রেড ইন্ডিয়ানদের একজন। সে আঙ্গুরের ক্ষেত করে আর ফলানো আঙ্গুর দিয়ে ওয়াইন বানায়। এই দলে চীন, ভারত আর আমেরিকার পর্যটক বেশি। কেউ বন্ধু, কেউ পরিবার নিয়ে এসেছে। আমি বাংলাদেশ থেকে আসা একাই নিজের সঙ্গী। সবাই যখন পাশের প্রিয় মানুষটিকে দেখিয়ে বলছে, দ্যাখো দ্যাখো কি অদ্ভুত রাতের নায়াগ্রা আমি দু চোখের সীমায় আপন মুখ দেখি না।
ক্রমাগত উপর থেকে ঝর্ণার গ্যালন গ্যালন পানি আসছে। কোন ঝর্ণা পাহাড়ের মাথারও ওপাশ দিয়ে আসছে তো পরেরটা পাথরের গা ফেটেই চুঁইয়ে নামছে। হাঁটতে হাঁটতে ভিজতে হচ্ছে, আবার বাতাসে খানিকটা শুকাচ্ছে। বলে রাখি, মাত্র কয়েক পা আগে যে পার্কের ভেতর দিয়ে এলাম সেখানে স্বল্প বসনারা গাছতলায় বসে বই পড়ছে। বুঝতেই পারছেন পুরো গ্রীষ্মকাল। অথচ এই ঝর্ণা জলের দুই পাহাড় সারির মাঝখানের পথে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সবাই শীতের কাপড় পরেছে মাত্র মাইল দুইয়ের জন্য।

আদিবাসী আমেরিকানদের এই পথে কেমন করে নিত্য যাতায়াত ছিল ভেবে পাইনা। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের একটা প্যাকেজ ট্যুরে এসেছিলাম। বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান দর্শনের পর এলাম এখানে। মূল পার্কটার দুপাশের হাইওয়ে ধরে এখন ইন্টারন্যাশনাল কার রেস হয়। পার্কের ভেতরে গাছ তলায় বসে মানুষ ধ্যান করে আর এসব ফেলে ট্রেইলে ঢুকলে তারপর পাবেন এই অদ্ভূত আঁধার। দুই মাইলের ভেতর ১৯টি ঝর্ণা। তখন আপনি বাইরের জগত থেকে পুরো বিচ্ছন্ন। নিচে শিলাখন্ডের মাথা গলে, পাশ দিয়ে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্রোতের ধারা। সেই পানিগুলো মিশছে ফিঙ্গার লেকে। ফিঙ্গার লেকের কথা একটু বলার লোভ সামলানো যাচ্ছেনা। স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া ছবিতে তাকালে দেখা যাবে পুরো এলাকাটার ভেতর দিয়ে শিরা উপশিরার মতো করে লেক বয়ে গেছে।
এই পথের সাথে হাজার বছর আগের মানুষের জীবনের গল্প আছে। দু’পাশে উঠে যাওয়া কালো পাথরের পর্বত খাঁজে আছে বুনো গাছ। তাকালে মনে হয় সেসবও শত বছরের স্থির চিত্র। হঠাৎ মাথার উপর ঝুলছে দড়ির সেতু। দুই পাহাড়ের সংযোগ। এখন আর কেউ ওভাবে যায়না যদিও। মাঝখান দিয়ে খরস্রোতা জলের ধারা তার নিচে পাথরের উঁচু নিচু চাই। সবচেয়ে অবাক করে অন্ধকার। পথ শুরুর কিছুক্ষণ পরই এমন আঁধার মনে হয় রাত নেমেছে, কয়েক পা যেতেই ঝকঝকে রোদ। এই অন্ধকারকে ‘সেনেকারা’ বলে রহস্যময় আলো।

ট্রেইলটার ট্রেড মার্ক ৮৩২। এই স্টেপ দিয়ে ভয়াবহ পিচ্ছিল পথটা পাড়ি দিতে হবে। এসেছি নিউ ইয়র্কের আপ স্টেটের ওয়াটকিন গ্লেন পার্কের ট্রেইলে। এখানে আসতেই নিউইয়র্ক থেকে বাসে সময় লাগে ঝাড়া সাড়ে ৪ ঘণ্টা। বরং নায়গ্রার দূরত্ব কম। মাত্র পৌনে তিন ঘন্টা আগে নায়াগ্রা ফলস দেখে ওয়াটকিন গ্লেনে আসার প্রস্তাবে দ্বিধা ছিল। কিন্তু ‘রেড ইন্ডিয়ান ট্রেইল লুপ’ শুনে উঠে বসেছি বাসের সামনের সিটে। যেন ওই সিটে বসলে সবার আগে আরও এক ঝলক বেশি দেখা যাবে।
ইউরোপীয়রা এদেশে আসার আগেই মূলত বেশ কয়েকটি আদিবাসী যারা হাজার বছর ধরে ছিল তাদের মধ্যে এদিকে সেনেকারা ছিল প্রভাবশালী। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ‘ফিঙ্গার লেক’ এর বরফ গলে জন্মানো ১১ টি লেকের মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ‘সেনেকা’। বরফ যুগের শেষে অন্তত ১৫ হাজার বছর আগে তার জন্ম। সেই সেনেকা লেকের পাশে ওয়াটকিন গ্লেন। এখানে পাশাপাশি ৩ টি ট্রেইল: গর্জ, ইন্ডিয়ান আর সাউথ রিম। বাঁ পাশে সাউথ রিম আর ডান দিকে ইন্ডিয়ান-এর মাঝখান দিয়ে গর্জ ট্রেইল। তিনটির শুরু ও শেষ একই জায়গায়।

প্রবেশের মুখে এনট্রেন্স টানেল। ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে পাথরগুলো হাতে কেটে তৈরি করা হয়েছে প্রবেশের পথ। প্রথমেই ৫২ ফিট নামতে হয়। প্রথম ১০ মিনিট হাইকিংয়ের পরই পাবেন সাসপেনশন ব্রিজ আর হুইসপারিং ফলস। ঝর্ণাটা পার হয়েই বুঝবেন নামকরণের সার্থকতা। কালো পাথরের উপর থেকে পানি নামছে আর গড়িয়ে যাচ্ছে যে পথ দিয়ে তা সবুজ গাছের ভেতর কেটে কেটে। ঝর্ণার শব্দ পাথর ও মাটির সাথে মিশে ভিন্নরকম শোনাচ্ছে। ঠিক পানির প্রবাহের শব্দ নয়, মনে হয় ফিসফিস করে কানের কাছে কেউ মুখ এনে কিছু বলছে। এখান থেকে ইচ্ছে হলে পথ বদলে সাউথ রিম বা ইন্ডিয়ান ট্রেইলে উঠে যাওয়া যায়। ব্রিজ তিনটি ট্রেইলের উপর দিয়েই টানা হয়েছে। আরেকটু এগিয়ে স্পাইরাল গর্জ পার হয়েই আরেকটি আশ্চর্য ঝর্ণা নামছে প্রাগৈতিহাসিক পাহাড়ের গা বেয়ে। তার নাম রেইনবো ফলস।
একটা কথা বলে রাখি, দুপাশের এই উঁচু পর্বত পেরিয়ে সামান্য বাতাসও আসার পথ নেই। যতটুকু আলো-হাওয়া মেলে তা সব দুইশ ফিট উঁচু দু’পাশের কালো পাহাড়ের সারির মাঝে উপরের সেই এক চিলতে আকাশের পৃথিবী থেকে। সেনেকারা যে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতো ওখান থেকেই পৃথিবীর শুরু। ট্রেইলের ঠিক এখান থেকে পথ ভয়ানক সরু। পাথরের গায়ে ফুল ফুটেছে, বুনো গাছ আর জলের গন্ধ মিলে এক বুনো বাতাস। বাতাসের শব্দের সাথে ঝর্ণা আর ধবল রঙের পাখির শব্দ। এখানে প্রতিধ্বনি উঠে।
তাকো দ্রুত আগাতে বললো, এমনিতেই অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছি। ভেজা কালো পাথরের উপর সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যেতেই শরীর ছমছম করে। খানিকটা গিয়ে আশ্চর্য এক জলাধার পেলাম হৃদয়াকৃতির। পাথরের ভেতর পানি জমে জমে তৈরি। পাশ কাটিয়েই লাভারস লাইন। পাথরের চাই তৈরি হয়ে উপরে উঁঠে বেঁকেছে যেমন তেমনি গুহার মতো তৈরি হয়েছে নিচের দিকে, সেখানে অন্ধকার ঘর।
ঘর দেখতে হবে ১০০ ফিট নেমে। পার হয়ে যে জায়গা তার নাম সেন্ট্রাল কাসকেড অ্যান্ড গ্লেন পুল। ৬০ ফিট উঠতে হবে আবার ‘স্কেনিক’ ব্রিজটায় গিয়ে। ওখান থেকেই পুরো পুলটা দেখা যায়। কষ্ট করে এ জায়গাটায় না উঠলে ঠিক বোঝা যায়না ট্রেইলের গঠন প্রকৃতি। নিশ্চই এতক্ষণে বুঝেছেন, মোটে দুই মাইল পথের ভেতরও চড়াই উতরাইটা কেমন! তারওপর ভয়াবহ পিচ্ছিল পাথরের গায়ে পদক্ষেপ। ক্যাথেড্রাল আর সেন্ট্রাল কাসকেড পার হয়ে সেই রেইনবো ফলস। এখানে রয়েছে প্লুটো নামের এক ঝর্ণা। রোমান দেবতার নামে নাম। ঝর্ণার সামনে স্বচ্ছতা, পেছনে অন্ধকার। গর্জ ট্রেইলের পথে মোট ১৯ টি ঝর্ণা যার প্রতিটি স্ব^তন্ত্র বৈশিষ্ট্যের।
দেড়শ বছর আগে দর্শণার্থীদের জন্য জায়গাটা উন্মুক্ত হলেও গর্জ ট্রেইলের জন্ম ১২ হাজার বছর আগে। বরফ যুগের বরফ গলে মাটি পাথর হয়ে হাজার হাজার বছর সময় লেগেছে এর ফর্মেশন হতে। তখন থেকেই এই স্রোত বইছে। এখান দিয়ে শিকার করতে যেত রেড ইন্ডিয়ানরা। এই স্রোতে মাছ ধরতে আসত, আবার গোত্রের ভেতর যুদ্ধ হলে এই ছিল তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গা। নেটিভ আমেরিকানরা বাস করতো আশেপাশে। এর নামই আগে ছিল ‘সালুবিরা’। ইতিহাসের নানা রকমফেরে সেই সালুবিরা হয়েছে জেফারসন, তারপর ওয়াটকিন এবং বর্তমানে ওয়াটকিন গ্লেন।
মাত্র কয়েকশ বছর আগের কথা। ১৭৭৮ সালের আগ পর্যন্তও এটা ছিল পুরোপুরি নেটিভ আমেরিকানদের অঞ্চল। ‘সুলিভিয়া মিলিশিয়া’ আর ‘ইরোকিউস’দের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে অধিকাংশ নেটিভ তাদের জমি বিক্রি করে চলে যায় অন্যান্য অঞ্চলে। ১৮২৮ সালে ওয়াটকিন ব্রাদাররা এখানে শুরু করে বাণিজ্য। তার আগের মানুষরা ছিল আধুনিক সংস্কৃতি বর্জিত। অসুখ হলে মুখোশ পরে রুগীর চারপাশে নেচে প্রার্থনা করতো। বাস করতো হাতে তৈরি বড় বড় বাড়িতে। সে সব বাড়ির দেয়াল আর ছাদ তৈরি হতো বন্য প্রাণীর চামড়া থেকে।

এ অঞ্চলে আঙ্গুর বাগান করে ওয়াইন তৈরির প্রচলন আদিবাসীদের সময় থেকে। বর্তমানে নিউইয়র্কের ওয়াইন কাউন্টি নামেই ডাকা হয় ফিঙ্গার লেক অঞ্চলকে। এখানে মাইলের পর মাইল আঙ্গুর চাষ হয় আর তার পাশেই কারখানা। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ওয়াইন উৎসবে যোগ দিতে আসে পর্যটকরা। আমাদের মতো স্বল্প আয়ের পর্যটকদের জন্য রয়েছে মাথা প্রতি ১০ ডলার করে নানারকম ওয়াইন চেখে দেখার সুযোগ।
তাকো আমাকে গল্প করছে পাখির পালক থেকে কেমন করে ইরোকয়রা পোশাক বানাতো, তার সাথে গেঁথে নিতো মাদুলি। মুখোশ তৈরির রঙ সংগ্রহ করা হতো বন্য ফুল ও ফল নিঙড়ে। এইসব ট্রেইলের সাথে তার পূর্ব পুরুষের সখ্যতা কতটা ছিলো আর এ অঞ্চলের জল, পাখির ডাক, বাতাসের শব্দ তাদের সাথে কতটা মিশে আছে সেই সব কথা।

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
জন্ম ১৯৮২ সালে ফরিদপুরে।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় যুগ্ম বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে
আছেন। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণা করেছেন ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ নিয়ে। ছোট গল্পের বই :  পা, রক্তমূলে বিচ্ছেদ ও বৈদিক পাখির গান। সম্পাদিত প্রবন্ধের বই ‘চেতনার উত্তরাধিকার’। পা গল্পের বইয়ের জন্য পেয়েছেন ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ ২০১৫। ঘুরেছেন জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমারসহ আটটি দেশে।