লিখেছেন: এস এম সাজ্জাদ হোসেইন
“কাব্যিকভাবে বলতে গেলে, নক্ষত্রবাড়ি একটি শিল্পসত্ত্বা যা তৌকির-বিপাশা শিল্পী যুগলের আত্মোপলব্ধি এবং স্বপ্নের রঙিন ক্যানভাসে ব্রাশ দিয়ে আঁকা একটি রিসোর্ট”
২০১৬ সালে আমার জন্মদিন উপলক্ষে যখন আমি সিটি ব্যাংক লিমিটেড-আমেরিকান এক্সপ্রেস থেকে একটি উপহার ভাউচার পেয়েছিলাম । তখন নিজেকে খুব স্পেশাল ভেবেছিলাম। প্রেফারড কাস্টমার হিসাবে তারা আমাকে নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট-এ এক রাত থাকার জন্য জন্মদিনের উপহার ভাউচার আমার ঠিকানায় পোস্ট করেছিল। ব্যাংকের এই উদ্যোগটিতে স্পেশাল ফিল হওয়াতে আমার ভালো লেগেছিলো বলে প্রতিদান হিসাবে, আমি আমার ভ্রমণ কাহিনিটি ওই ব্যাংকের সকল কর্মকর্তাদের প্রতি উৎসর্গ করেছিলাম । উৎসর্গের ক্ষণটি আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও আমার স্পন্সরশিপের বদৌলতে ২০২০ সালের বইমেলায় প্রকাশিত আমার প্রথম বই ভ্রমণবিলাস-এর একটি পর্বে উৎসর্গের কারণটি ব্যাখা করা হয়েছিলো । একজন লেখকের মনের ভেতর থেকে যখন কোন স্বীকারোক্তি আসে, তাহলে ধরে নিতে হবে সেটা ছিল নিঃস্বার্থ বা নিঃসঙ্কোচ মনোভাব যার কোন বিনিময় হতে পারেনা ।
নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট-এ যাওয়ার আগে গুগল সার্চ করে যেটা বুঝেছিলাম, রিসোর্টটি ৯০ দশকের বিখ্যাত অভিনয়শিল্পী ও আঁকিয়েশিল্পী তৌকির-বিপাশা যুগলের তৈরি রিসোর্ট । নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট-এ গেলে শিল্পীসত্ত্বার ছোঁয়া চারিদিকে পাওয়া যাবে যার প্রতিফলন আমার লিখনিতে অনুভূত হবে ।
ঢাকা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে নক্ষত্রবাড়ি। যে কেউ চাইলে প্রাইভেট গাড়িতে করে ২ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন। গ্রামীণ পরিবেশের ভেতর আধুনিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত এই রিসোর্টটিতে শান্তি ও শিল্পীসত্ত্বার দারুণ ছোঁয়া আছে। আমি, আমার গিন্নি ইমা আর আমাদের বড় ছেলে ইবতিহাজ প্রতিটি ক্ষণ এই রিসোর্টটিতে আমাদের ২৪ ঘণ্টার স্থায়িত্বকাল ভীষণ উপভোগ করেছিলাম Ñহোক সেটি খাবার, হোক আশপাশের পরিবেশ, হোক প্রাকৃতিক পরিবেশ, হোক অবসর সময় কাটানোর মুহূর্ত।
দুপুর ১টার দিকে সেখানে পৌঁছে আমরা নিজেদের সতেজ করে তুলেছিলাম ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক পানের মধ্য দিয়ে আর লাঞ্চে বাংলা খাবারের মেনু বেছে নিয়ে। আমি সবসময় বলি গুড ফুড চেঞ্জেস মুড। ভালো মানের খাবার যদি আপনি একটি দারুন পরিবেশে খান তাহলে সত্যিই আপনার মেজাজ পরিবর্তন হতে বাধ্য। আমার এতটাই উদ্দীপ্ত ছিলাম যে দুপুরের খাবারের পর আমরা ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় ধরে রিসোর্টের আশপাশে ঘুরে বেড়িয়েছি আর ছবি তুলেছি। রিসোর্ট-এর কোন একটি অংশে দোলনা আছে যেটার পাশেই একটি কামরা আছে, সেটার বর্ণনা আমি একটু করতে চাই । দোলনাতে চড়ে আমার গিন্নীর ইচ্ছা হলো ছবি তোলার । ছবি তুলে দিলাম মা-ছেলের একসাথে আর আলাদা করে । তবে আমার বেশি ভাল লেগেছিল ঐখানে বানানো কামরাটির বাইরের স্থাপত্যকলা দেখে । পুরো কামরার বাইরের অংশটি এক ধরনের লতা জাতীয় গাছ (ক্রিপার ট্রি) দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল যেটা দেখে আমার আর ইমার মনে হয়েছিলো আমরা টাইম মেশিনে করে শেক্সপিয়ার আমলের কোন ব্রিটিশ কান্ট্রিসাইড বাড়ির উঠানে অবস্থান করছিলাম । সত্যি বলছি, উপমাটা আমার লিখনিতে বেশি মনে হলেও আপনি যখন সামনা সামনি দেখবেন তখন ওরকম মনে হবে । পরে জানতে পারলাম, কামরাটি ছিল তৌকির-বিপাশার ব্যাক্তিগত রুম যেখানে উনারা অবস্থান করেন ওনাদের অবকাশ যাপনকালীন সময়ে ।
আমাদের সাড়ে আট বছরের ছেলেটি আমাদের সাথে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছে কারণ যান্ত্রিক শহর জীবনে আমরা খুব কমই এরকম পরিবেশ পেয়ে থাকি। আমাদের সবার রিসোর্টের সবুজের সমারোহ এবং অজস্র জাতের দেশি-বিদেশি উদ্ভিদ ও ফুলের কালেকশন দেখে ভালো খুব লেগেছিল।
শীতের শেষ দিকে গিয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, ফেব্রুয়ারির ঠিক এরকম সময়ই গিয়েছিলাম । খুব আরামদায়ক আবহাওয়া ছিল । আমাদের কটেজ সম্পর্কে একটু বর্ণনা না দিলে পাঠকরা বুঝতে পারবেন না যে তারা আসলে কোনটা বেছে নিবেন ।
শাল গাছ আর অন্যান্য গাছের প্রাচুর্যতায় ভরপুর গোটা রিসোর্টটি।
রিসোর্ট-এর একদিকে কনক্রিটের বিল্ডিং যেটার চারতলায় আমরা ছিলাম । আমাদের রুমের সামনের ব্যাল্কনি থেকে নিচের দিকে তাকালেই সবুজের সমারোহ দেখে চোখের খুব আরাম অনুভূত হয় । বিল্ডিঙের ভেতর দিয়ে শাল গাছের নান্দনিক সমন্বয়তা ছিল অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন । এটা দেখলেই বোঝা যায় কতটা প্রকৃতিপ্রেমী হতে পারে এই শিল্পীযুগল ।
আরেকদিকের কটেজ ছিল সম্পূর্ণ দেশীয় অবয়বে তৈরি কাঠ, গাছের গুড়ি, বাঁশ, বেড়ার ছাউনি, বেত এগুলোর সমন্বয়ে একটি গ্রামীণ আবহের । আমরা সবাই কম বেশি এই কটেজের ছবি দেখেছি বিভিন্ন নাটকের দৃশ্যায়নে । সামনেই ঠিক একটি পুকুর আছে যেখানে নৌকা করে চড়ে বেড়ানো যায় ।
আমরা ঘণ্টা খানিক বিশ্রামের পর সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা আর নাস্তা সেরে ল্যাপটপে আমরা কমেডি মুভি দেখতে বসে গিয়েছিলাম । দারুন সময় কাটছিল আমাদের । যেন রূপকথার গল্পের মতো । আমরা অনেক বিশেষায়িত কথা বলেছিলাম সারাদিনের মুহূর্তগুলি নিয়ে। যেটার রেশ আমাদের ছেলের ভেতরেও গেঁথে গিয়েছিল । রাতের খাবারের মেনুতে আমরা রুচির পরিবর্তন এনে থাই খাবার অর্ডার করেছিলাম। আমি আবারও বলছি, ভাল খাবার আপনার মেজাজ মর্জি বদলে দিতে পারে। আমার বেলায় এটি ভীষণ প্রযোজ্য কারণ ইমা যখন বাসায় ভালো খাবারের আয়োজন করে তখন আমি ভীষণ খুশি হই। এটা আমার চোখে মুখে ফুটে ওঠে।
দিনটি খুব ক্লান্তিকর ছিল, তাই আমরা তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গিয়েছিলাম কারণ পরের দিন ভোরবেলা রিসোর্টের আশপাশ এক্সপ্লোর করবো বলে। এই অভ্যাসটা আমি ভালোমতো রপ্ত করে নিয়েছি। যথারীতি, আমি ভোরবেলায় রিসোর্টের বাইরের পরিবেশ উৎঘাটন করতে বেরিয়েছিলাম। আমার ছেলে আমাকে অনুসরণ করেছিলো। কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে থাকা নক্ষত্রবাড়ির পরিবেশটি খুবই মনোরম ছিল, এমনকি আমরা গ্রামের আশপাশ দিয়েও ঘুরে ফিরেছি। প্রায় ২ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করে বেশ কিছু পাখি এবং প্রকৃতির ছবি তুলেছিলাম।
ইষ্টিকুটুম ।
হলদে-কালো ইষ্টিকুটুম, সাদা ভ্রূ খঞ্জন ও দোয়েল, খয়েরি ঘুঘু আর চড়ুই পাখির ছবি তুলে মনের খুব শান্তি হয়েছিলো । আমি ব্যাক্তিগতভাবে পাখিদের ছবি তুলে ভীষণ আনন্দ পাই । আর যেসমস্ত জায়গায় পাখি আসে, সেখানে “গুড লাক” থাকে বলে আমি মনে করি ।
আরেকটা দৃশ্য আমার স্মৃতিপটে লেগে আছে । দৃশ্যটির বর্ণনা একটু করবো পাঠকদের উদ্দেশ্যে । চারতলার এক কোণ থেকে নিচে কনক্রিটের ওপর বিশাল আকৃতির নীল রঙের লোগোটা ঢেকে ছিল কুয়াশার চাঁদরে । দারুণ একটা দৃশ্য । ব্র্যানডিং সেন্স খুব প্রখর বলতেই হবে শিল্পী যুগলের । গ্রামের পরিবেশ থেকে ন্যাচারাল স্যুভেনির হিসাবে, আমি ও ইবতিহাজ এক টুকরো সবুজ চিকন বাঁশ নিয়ে এসেছিলাম যা আমাদের ঢাকার বাসার বাগান-কোণে বহুদিন শোভা বর্ধন করেছিল।
মোবাইল ফোনে আমি ইমাকে প্রাতঃরাশের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলাম। আমারা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে একসাথে রেস্তোঁরায় পৌঁছে সকলে মিলে আমাদের প্রাতঃরাশটি উপভোগ করেছিলাম। একটা কোণে টেবিল বেছে নিয়ে চা খাওয়ার মুহূর্তে আমি আর ইমা নিঃশব্দে সময়টিকে উপভোগ করেছিলাম আর ইবতিহাজের দুরন্তপনাকে গ্রাহ্য না করে বরং ওকে ওর মতো করে দুষ্টুমিতে শায় দিয়েছিলাম । যান্ত্রিক জীবন থেকে একদিনের অবসর মুহূর্তটি আমাদের মতো ওয়ার্কিং কাপলের জন্য যেরকম আনন্দদায়ক ছিল অন্যদিকে আমাদের ছেলের নিরলস ছুটে বেড়ানো ছিল আরও সুখকর কারণ নগর জীবনে চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আমাদের বন্দি জীবন আর বর্তমান প্যানডেমিকের কথা মনে হলেতো ১০ বার মরে যেতে ইচ্ছে করে ।
কাঠের তৈরি নান্দনিক একটি ব্রিজ ।
রিসোর্ট-এর আরেকটি নান্দনিক দৃশ্য আমাদের দুজনের চোখ এড়ায়নি । কাঠের তৈরি একটি ব্রিজ আছে যেখানে অক্সিজেনে ভরপুর । ঝুলন্ত গাছের সমারোহ সেখানে । প্রাকৃতিক মেলবন্ধনে অনেক সুন্দর ছবি তুলেছিলাম আমরা সবাই । আপনারা যদি পরিবার নিয়ে যেতে পারেন, তাহলে ছবি তুলতে যেন ভুলে না যান, সেজন্যই মনে করিয়ে দেয়া ।
আমাদের ছেলের দুরন্তপনার একটি উদাহরণ দেই । চমৎকার সুইমিং পুল আছে রিসোর্টটিতে । পানি দেখে আমাদের ছেলে পুলটিতে নেমে গেলো অবলীলায় । এক কোণে দাঁড়িয়ে পানিতে কিছুক্ষণ লম্ফ ঝম্ফ করে উঠে এলো । ছেলের কীর্তি দেখে আমিও সাঁতার কাটলাম মিনিট দশেকের মতো । পুরো ব্যাপারটি ছিল ভীষণ স্বস্তিদায়ক । একদম সানবাথ বলতে যা বোঝায়!
রিসোর্টের আতিথেয়তা এবং শৃঙ্খলতা আমাদের কাছে খুব ভালো লেগেছিলো। তাদের শৃঙ্খলতার একটা নমুনা দেই। ইমা একটি অ্যাকুরিয়াম উদ্ভিদ পছন্দ করেছিলো এবং স্টাফদের অনুরোধ করেছিলেন একটি গাছ দেওয়ার জন্য। তারা আমার স্ত্রীর সাথে সুন্দর একটি হাসি দিয়ে জবাব দিয়েছিলেনÑ দুঃখিত ম্যাডাম, এটি সম্ভব নয় এবং এগুলো আমাদের ম্যাডামের শখের এবং বাইরের দেশ থেকে সংগ্রহ করেছেন। আমরা ক্ষণিকের জন্য দুঃখ পেয়েছিলাম তবে তাদের মূল্যবোধ এবং পেশাদারিত্বকে আমরা সম্মানের চোখেই দেখেছিলাম। কাব্যিকভাবে বলতে গেলে, নক্ষত্রবাড়ি একটি শিল্পসত্ত্বা যা তৌকির-বিপাশা শিল্পী যুগলের আত্মোপলব্ধি এবং স্বপ্নের রঙিন ক্যানভাসে ব্রাশ দিয়ে আঁকা একটি রিসোর্ট। আমার সমস্ত পাঠকদের বলবো, সুযোগ পেলে ঘুরে আসুন ঢাকার অদূরে নক্ষত্রবাড়িতে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, এটি আপনাকে হতাশ করবে না।