Skip to content Skip to footer

মেলবোর্ন: রূপালী মানবী

কাজী সাইফউদ্দীন বেন্নূর

সেদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে মুখোমুখি দুই স্বাগতিক দেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। সাল ২০১৫, তারিখ ২৯ মার্চ। আমরা দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলাম বিশ্বকাপ চলার মাঝেই। বাংলাদেশ দুর্দান্ত খেলেছিল, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ভারতের সঙ্গে বিতর্কিতভাবে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল। ক্রিকেট উত্তেজনায় ভাসছে বাংলাদেশ। আমরা সেই উত্তেজনার হলকা নিয়ে পা রেখেছি অস্ট্রেলিয়ায়।

ফাইনালের দিন পড়ে গেলো সিডনি থেকে মেলবোর্ন যাওয়ার ভ্রমণ-সূচিতে। ঢাকায় থাকতেই ঠিক করেছিলাম, রাতের দিকে বিমানের টিকেট কাটব। খেলা শেষ হওয়ার পর যদি শহরে উন্মাদনা থাকে, বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছানো ঝামেলামুক্ত হবে।

সিডনি শহরে প্রবাসী বন্ধুদের কল্যাণে টিভিতে খেলা দেখা হলো। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো অস্ট্রেলিয়া। রাত ১১টার ফ্লাইটে পৌঁছলাম মেলবোর্ন। হোটেলগামী বাসে চড়ে ভাবলাম, রাস্তা হলুদ জার্সি আর ফেস্টুনে ঢেকে যাবে। কিন্তু শহর পুরো শুনশান। কোন মিছিল নেই, কোন জটলা নেই। বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে হোটেলের বিছানায় আশ্রয় নিলাম।

পরদিন সন্ধ্যায় মেলবোর্ন প্রবাসী ছোটভাইতুল্য আশফাক ও তার স্ত্রী নৈশভোজে এলে জানতে পারলাম, ভিক্টোরিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা “অসি রুল্স ফুটবল” বা ফুটি। পুরো অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেটের দর্শক কেবল ২৫%। এক দশক ধরে দেশটি ক্রিকেট বিশ্বকে দাপটের সঙ্গে শাসন করলেও এখন দর্শক কমে গেছে।

“ঢাকা শহরে বেড়াতে এসে টঙ্গি শহর দেখাচ্ছেন, মেলবোর্ন দেখানোর ব্যবস্থা করুন।” বাসে এক সফরসঙ্গী বললেন। আমরা গ্রেট ওশান রোডের ভ্রমণে যাচ্ছিলাম। ভোরে দ্রুত নাস্তা সেরে সকাল ৭টার মধ্যে বাসে ওঠার কথা। প্রথম দুই ঘণ্টায় মেলবোর্ন দর্শন, এরপর টোর্কি অভিমুখে যাত্রা। কিছু ঘুমকাতুরে সফরসঙ্গীর কারণে ট্যুর অপারেটর সিদ্ধান্ত নিলেন সরাসরি টোর্কি যাওয়ার। গ্রেট ওশান রোডের ভ্রমণ কিছুটা ছাঁটাই করা হলো।

বাস ছুটল মফস্বল অভিমুখে। দুই পাশে ঘন সবুজ বন, বিস্তীর্ণ মাঠ, দূরে নীল আকাশের সঙ্গে মিশে যাওয়া দৃশ্য। দুই ঘণ্টার বেশি সময় পরে পৌঁছলাম টোর্কি সৈকতে। সোনালী বালি, পাইনের সারি, নীল সমুদ্র আর ফেনিল তরঙ্গ। সার্ফ বোর্ডে তরুণ-তরুণীরা নেচে চলেছে, যেন বুনো ঘোড়ায় চড়ছে।

টোর্কি থেকে গ্রেট ওশান রোড ধরে বাস ছুটল। ডানদিকে সমুদ্র, বামদিকে সবুজ পাহাড়, গ্রাম, ক্ষেত। চোখ অচেতন ভীড়ের মতো এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে ছুটছে। “অ্যাপোলো বে” শহরে পৌঁছে দুপুরের খাবার নিয়ে আবার মেরিন ড্রাইভ ধরে চলা শুরু।

দেড় ঘণ্টা পরে পৌঁছলাম টুয়েল্ভ্ অ্যাপোসল্স্-এ। সমুদ্রের মধ্যে দাঁড়ানো চুনাপাথরের স্তম্ভ। মূলত নয়টি ছিল, ২০০৫ সালে একটি ভেঙে গেছে। ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রতিদিন ক্ষয় হচ্ছে। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা এটিকে যিশুর বারোজন শিষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন।

ফিরতি পথে মেলবোর্ন অভিমুখে বাস ছুটল, এবার সরাসরি স্থলভাগ ধরে। হেলিকপ্টার ট্যুরের সুযোগ ছিল, তবে সময়ের অভাবে তা বাদ দিতে হলো। সকাল থেকে দিনের আলোতে শহর দেখা গুরুত্বপূর্ণ।

মেলবোর্ন শহরের মূল দর্শনীয় স্থানগুলো বাস থেকে দেখা হলো। রয়েল এক্সিবিশন হল, ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট স্টেশন, ফেডারেশন স্কয়ার। হোটেলের কাছাকাছি ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট ঘড়ির নীচে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলন প্রথা চলছে।

MCG স্টেডিয়াম ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য স্বপ্নের স্থান। ১৮৭৭ সালে প্রথম টেস্ট ম্যাচ, ১৯৭১ সালে প্রথম ODI অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৮১ সালের আন্ডার-আর্ম বোলিং বিতর্কও এখানে ঘটে। আমরা স্টেডিয়ামের ভিতরে ঢুকতে পারিনি, তবে আশেপাশের পরিবেশ উপভোগ করলাম।

মেলবোর্নে আগেরবার ২০১০ সালে এসেছিলাম মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল সম্মেলনে। বৃষ্টিভেজা শহর, হোটেল থেকে কনভেনশন সেন্টার যাত্রা। পরদিন বিকেলে বেরিয়ে ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট ঘড়ি দেখলাম। শহরের সৌন্দর্য, ফেডারেশন স্কয়ার, নদী, ব্রিজ সব মুগ্ধ করেছে।

বর্ষা-স্নাত সন্ধ্যায় ফেডারেশন স্কয়ারে দাঁড়ালাম। নিজের হৃদয়-স্পন্দনে শোনা গেল প্রাচীন প্রেমিক-প্রেমিকার আঁকুতি। বৃষ্টির মধ্যেও যুগলরা জড়ো, প্রেম বয়ে চলেছে নদীর মতো। আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করলো না। মেলবোর্ন নিজেই যেন “রূপালী মানবী”—বর্ষার ফোটা ভেজা, চুপচাপ, কিন্তু অনন্ত সৌন্দর্যের প্রতীক।