লিখেছেন: অম্লান চক্রবর্ত্তী
“আচ্ছা, এখানে এখন স্নো ফল হবার চান্স নেই, না?” ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিয়ে দীপান্বিতা বলল। কুমায়ুন হিমালয়ের গোয়ালদাম গ্রামের একটি কাফেতে বসে আছি আমরা। বরফে দেখা গাড়োয়াল হিমালয়ের পাহাড়চুড়োগুলি সামনে দেখা যাচ্ছে। আর আমাদের ব্রহ্মতাল ট্র্যাক শুরুর আগেই উত্তেজনায় জমে দই।
“হলে মন্দ হয় না” সিগারেটে একটা লম্বা দম নিয়ে আমি বললাম। “তবে তা শেষ দিনে হলেই ভালো। কারণ ট্রেকটা সম্পূর্ণ হওয়াটা মূল লক্ষ্য।” বিধাতা হয়ত অলক্ষ্যে হেসেছিলেন আমার কথা শুনে আর তাই আমাদের পড়তে হল তুষারঝড়ে, আর ট্রেক অসম্পুর্ন্য হওয়া সত্ত্বেও আমার বা আমাদের সবার জীবনের সবচেয়ে একটি স্মরণীয় ও সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়ে থাকলো ট্রিপটা।
গোড়া থেকে শুরু করা যাক। জানুয়ারির মাঝামাঝি আমরা ছয় জন বন্ধুবান্ধবী মিলে ঠিক করলাম, ব্রহ্মতাল ট্রেক করবো। এই একটি উত্তরাখন্ড রাজ্যের জনপ্রিয় “উইন্টার ট্রেক”। সেই মতো, কলকাতা থেকে বিমানে দিল্লি ও সেখান থেকে রাতের ট্রেন ধরে ভোরবেলা কাঠগোদামে এসে পৌঁছেছি। কাঠগোদাম কুমায়ুন হিমালয়ের প্রবেশদ্বার। আমাদের লক্ষ্য গাড়োয়াল হিমালয়ের অন্তর্গত ব্রহ্মতাল ট্রেক। মূল পায়ে হাঁটা পথটি গাড়োয়াল হিমালয়ে অন্তর্ভুক্ত হলেও বেস ক্যাম্প গোয়ালদাম কুমায়ুন অঞ্চলের অন্তর্গত। তাই গাড়োয়ালের প্রবেশদ্বার অর্থাৎ হরিদ্বার বা দেরাদুন অপেক্ষা কাঠগোদাম পৌঁছে নৈনিতাল -কৌশানি – আলমোড়া হয়ে গোয়ালদাম অপেক্ষাকৃত সহজেই পৌঁছনো যায়।
ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কাঠগোদাম পৌঁছে গাড়ি নিয়ে আমরা চলেছি লোহাজংয়ের উদ্দেশ্যে। কৌশানীর কাছে পৌঁছেই তুষার শিখর দেখা গেছে। আনন্দের চোটে সবাই এমন চেঁচিয়ে উঠেছিলাম যে ড্রাইভার বেচারা চমকে উঠে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিলেন। গোয়ালদাম যখন পৌঁছলাম, তখন বিকেল সাড়ে তিনটে। মন চাইছে এক কাপ কফি। আর তাই পথের ধারে একটি কাফেতে বসা।
কফি শেষ করে আমরা পুনরায় গাড়িতে চেপে লোহাজং যখন পৌঁছলাম, তখন সূর্য্য প্রায় অস্তগামী। শেষ বিকেলের আলোর প্রতিফলনে সোনা রং ধরেছে সামনে নন্দাঘুন্টি পর্বতে। দীর্ঘ পথশ্রমের ধকল ছিলই, আমরা জলদি রাতের খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ভোরবেলায় উঠে আমরা ট্রেকিংয়ের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আলুর পরোটা সহযোগে প্রাতঃরাশ সেরে নিলাম। ইতিমধ্যে আমাদের গাইড চন্দন নেগি এসে গেছেন। খচ্চরের পিঠে মালপত্র, তাঁবু, রান্নার সরঞ্জাম সব বাধা হল। আর আমরাও পায়েদলে পাহাড়ে চড়া শুরু করলাম। ছয় জনের মধ্যে আমার ট্রেক অভিজ্ঞতাই সব থেকে বেশি। আগে হিমালয় অঞ্চলে চারটি ট্রেক করেছি। অন্যান্যদের মধ্যে দীপান্বিতা, নাসমিন, ইন্দিরা সান্দাকফু ট্রেক করলেও সুদর্শন ও তন্ময়ের এবারই প্রথম পাহাড় চড়া। তাই ঠিক হল আমাদের গাইড শ্রী চন্দন নেগি সবার আগে চলবেন। তারপর বাকি দল এবং সব শেষে আমি। এর সুবিধে হল, মাঝপথে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা ক্লান্ত বোধ করলে যাতে আমি তাঁকে কিছুটা সাহায্য করতে পারি বা মানসিক ভাবে সাহস জোগাতে পারি।
পাহাড়ের ধার দিয়ে সুন্দর পায়ে চলার পথ। ইংরিজিতে যাকে বলা হয় “ট্রেল”। সেই ট্রেল ধরে এঁকে বেঁকে পাহাড় চড়া। আর প্রথম দিনের ট্রেক সাধারণত জঙ্গলের মধ্য দিয়েই হয়। কিন্তু এবার দেখি সেই পথ সবুজের বদলে ঊষর। গাছের সংখ্যা কম। আর একটু পরেই দেখি রীতিমতো “ট্রাফিক জ্যাম”। অন্তত একশো জন ট্রেকার চলেছেন রাস্তা দিয়ে। তার সাথে খচ্চরের দল যাচ্ছে মালপত্র নিয়ে। রাস্তা দিয়ে রীতিমতো ধুলো উড়ছে। একটু মনমরাই হয়ে গেলাম। সুন্দর সবুজ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে ট্রেক করার বদলে , কিন্তু এ কি রাস্তা!!! এতো লোক, কোলাহল কিছুটা বিরক্তির উদ্রেক করল। নির্বিচারে বন ধ্বংসের কারণে ধুলো বেড়ে গেছে অনেক। যাইহোক, কিছুদূর চলার পর আমরা পৌঁছলাম বেগম নাম এক ছোট্ট চটিতে। একটি চায়ের দোকান। স্থানীয় গ্রামবাসীরাই চালান। একটু বেশি সময় নিয়ে চা খেয়ে আবার শুরু হল চলা। সময় অপচয় নয়, বরং একটু ভীড় কমার জন্য অপেক্ষা করলাম আমরা। বাকি সব দলকে ছেড়ে দিলাম এগোনোর জন্য। ভোর বেলায় বেরিয়েছিলাম, হাতে সময় আছে অনেক।সত্যি বলতে, প্রকৃতির কোলে যে নিসর্গের আকর্ষণে বারবার পাহাড়ে আসি, তা প্রায় নেই বললেই চলে। এবার অবশ্য চলা শুরুর পর একটু ফাঁকা রাস্তা পাওয়া গেলো।
আরও ঘন্টা তিনেক হাঁটার পর আমরা পৌঁছলাম বেকাল তাল ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে। একটি বিশাল বুগিয়ালের মধ্যে প্রায় সত্তর-আশিটা তাঁবু। পাহাড়ের মাঝে জঙ্গলহীন খোলা প্রায় সামতলিক ক্ষেত্রকে উত্তরাখণ্ডে বুগিয়াল বলা হয়। পৌঁছে দেখি, নেগি ও তার দলবল আমাদের তাঁবু আগে থাকতেই বিছিয়ে রেখেছেন। নেগি আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। তাই তাঁবু খাটিয়েছেন বিশাল বুগিয়ালের একটু উপরে। পৌঁছনো মাত্র গরম স্যুপ ও পাকোড়া খাওয়া হলো।
“নাম তো বেকাল তাল, কিন্তু হ্রদ কোথায়?” দীপান্বিতা প্রশ্ন করল। আসলে চারপাশে কোনও জলাশয় চোখে পড়ছেনা।
“যতদূর মনে হয় সামনের পাহাড়টা পেরিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে। “ আমি উত্তর দিয়ে নেগির দিকে তাকালাম। নেগিও সম্মতি সূচক ঘর নাড়লেন। ঠিক হলো দুপুরে খাওয়ার পর যাওয়া হবে বিকাল তালে। তন্ময় ও সুদর্শন প্রথমবার ট্রেক করছে – স্বভাবতই প্রচন্ড পরিশ্রান্ত। পায়ের সমস্যা হচ্ছে। ওদের খানিকক্ষন স্ট্রেচ করানোর পর খাবার খেয়ে আমরা হাঁটতে বেরোলাম।
সামনের পাহাড়টির মাথায় চড়তেই নিচে বেকাল তাল দৃশ্যমান হল। পাহাড়ের ঢাল বরাবর নেমে এসে দেখি হ্রদটির জল অস্বাভাবিক স্বচ্ছ। আরেকটু এগোতেই ইন্দিরা উচ্ছসিত গলায় বলে উঠলো, “আরে, এ তো ফ্রোজেন লেক”। আসলে গত সপ্তাহে বরফ পড়ার পর থেকেই উপরের স্তরটা সম্পূর্ণ জমে গেছে। বিদেশে জমাট বাঁধা হ্রদ এমনকি সমুদ্র দেখলেও দেশে কখনও দেখিনি। তন্ময় রীতিমতো হ্রদের বরফের আস্তরণের উপর লাফাতে শুরু করল। ওকে দেখে আমার মনে পড়ল “চাঁদে টিনটিন” কমিক্সে জনসন ও রনসনের চাঁদে নৃত্যের কথা।
পাহাড়ে বিকেল হতে হতেই সন্ধ্যে হয়ে যায়। সেই কথা মাথায় রেখে আমরাও ফিরে এলাম ক্যাম্পে। তাপমাত্রা শূন্যের নীচে। শীতের পোশাকে সুসজ্জিত থাকলেও মাঝে মধ্যেই গাড়োয়ালী হিমেল বাতাস কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। খিচুড়ি ও আলু ভাজা সহযোগে রাতের খাবার সেরে আমরা ঢুকে পড়লাম তাঁবুর ভিতর। আর নিজেদের সমর্পন করলাম স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণ নরম আদরে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। জ্যাকেট পরে তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি জাগানিয়া গান গাওয়া পাখিটা তখনও সুরসুধা অর্পণ করছে ভোরের নরম আলোর উপর। যেমন মিষ্টি গলা, তেমন রূপ। নীল গলা, গায়ের রং সবুজ। নাম না জানা পাখিটা আমাকে একটা মিষ্টি সকাল উপহার দিল।
ট্রেক করার সময় প্রথম রাতের পর ভোর খুব গুরুত্বপূর্ণ। জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম ব্যবস্থার মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া এবং প্রকৃতির খেয়াল অনুযায়ী অভিযোজনের প্রস্তুতি এই সময়েই হয়। সেদিন খুব বেশি হাঁটা পথ নেই। আমরা ধীরে সুস্থে আচার সহযোগে আলুর পরোটা খেয়ে পথ চলা শুরু করলাম।
প্রথম পাহাড়টির মাথায় উঠেই পাইন বনে প্রবেশ করলাম। ডান দিকে তাকিয়েই দেখি সর্বাঙ্গ তুষার শোভিত মাউন্ট ত্রিশূল। সূর্য্যের আলো পরে ঝকঝক করছে।
ঘন্টা চারেক হাঁটার পাইন বনের শেষ ও বুগিয়ালের শুরু। অন্যান্য যাত্রীদল এই বুগিয়ালের শেষে তাঁবু খাতায় যাতে পরদিন ব্রহ্মতাল খুব সহজে পৌঁছতে পারে। কিন্তু আমাদের ভালো লেগে গেলো এই জায়গাটা। পরদিন হয়তো ২ কিলোমিটার বেশি হাঁটতে হবে। কিন্তু মন যখন লেগে গেছে,তাবু খাটানোর শর্তগুলি ও পূরণ হচ্ছে, অতয়েব দ্বিধা করা উচিত নয়। বাকিদেরও একই মত। তাঁবু খাটানো শুরু হল।
বুগিয়ালটি যাকে বলে “ট্রি লাইন জোন” তার উপরে এবং একটি পাহাড়ের পিঠে। এর অপর পিঠেই ব্রহ্মতাল। সামনের দিকে জঙ্গল। বাকি এক দিকে পাহাড়ের একটি শিরা আর অন্য দিকে গোটা আকাশ জুড়ে মাউন্ট ত্রিশূলের গর্বিত অবস্থান।
কিন্তু দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারতেই মাউন্ট ত্রিশূলের উপর দেখি এক খন্ড মেঘ। নাসমিনকে বললাম, “পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি এই এক খন্ড মেঘ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কিভাবে গোটা আকাশ মুড়ে দেয়। আর এই মেঘ যদি ঝরে পরে, তবে স্নো ফল হবেই।”
ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই পুরো আকাশ হয়ে উঠলো গম্ভীর। দীপান্বিতা যদিও উৎপলা সেনের “আকাশ ছেয়েছে ওই কাজল মেঘে” গানটা গাইছিলো, কিন্তু বাইরের দৃশ্যমানতা কমে যেতেই আমরা সকলে মিলে একটি তাবুর মধ্যে বসে গল্প করতে শুরু করলাম। তিন জনের ডোম টেন্টে ছয়জন বসে গল্প করতে পারে সহজেই। আর তখনই শুরু হল তুষার ঝড়।
তুষারপাত বা তুষারঝড় নিয়ে যে রোম্যান্টিসিজম আমাদের মধ্যে ছিল তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগল না। “সোনার কেল্লা” ছবিতে যেমন উটের পিঠে সওয়ার হয়ে লালমোহনবাবু বলেছিলেন “উটের পিঠে চড়ার স্বপ্ন এখন কঠিন বাস্তব” তেমনই অবস্থা হল আমাদের। সাইঁ সাইঁ শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছিল তাঁবুর বাইরে কি চলছে। বাতাসের দাপটে তাঁবু কাঁপছে। ভয় হচ্ছে এই বুঝি ভেঙে পড়ল। টেন্ট উইন্ডো খোলার দুঃস্বপ্ন ও কেউ দেখাচ্ছিলাম না।
কিন্তু বড় সমস্যা দেখা দিল যখন ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই তাঁবুর ছাদ বরফের চাপে ঝুলে পড়ল। অভিজ্ঞ গাইড চন্দন সময়মতো এসে আমাদের জানালেন তাঁবু ঝাড়তে হবে। নয়তো ভেঙে পড়বে। সবাই মিলে তড়িঘড়ি বাইরে এসে তাবু ঝাড়া শুরু হল। “তিব্বতে টিনটিন” কমিক্সে সেই ঝড়ের দৃশ্য মনে পড়ছিল। দুই ফুট দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছেনা। পাশে দাঁড়িয়েও চেঁচিয়ে কথা বললে তবেই ক্ষীণ স্বর কানে আসছে। এর মধ্যে হঠাৎ তন্ময় ভয়ার্ত গলায় “ইয়েতি” “ইয়েতি” করে চেঁচিয়ে উঠল। কারণটা কিছুই নয়। পাশে কালো জ্যাকেট ও টুপি পড়া সুদর্শন প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে একটু আড়াল হয়েছিল। তন্ময় এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে একটু মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে মনে হচ্ছিল।
নেগি বললেন, একবারে রাতের খাওয়া সেরে নিতে। অবাক হয়ে দেখলাম, এই দুর্যোগের মধ্যেও রান্না হয়েছে। রাতে ঝালঝাল ডিমের কষা ও রুটি খেয়ে আমরা ঘুমোতে গেলাম। কিন্তু সারা রাত আর কারও ঘুম হলনা। বারবার উঠে তাঁবু ঝাড়তে হচ্ছে। রাত তিনটে নাগাদ ঝড় থামার পর আমরা অবশেষে একটু দুই চোখের পাতা এক করলাম।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো দেরিতেই। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে দেখি চারপাশের গোটা পৃথিবীটা বদলে গেছে। চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ। আমাদের তাঁবুর অর্ধেক বরফের তলায়। সামনে পাইন বনের গাছের পাতা বরফ ভারে নত। আর সব মেঘ কেটে গিয়ে ঝকঝকে আকাশ। সকালের আলো পড়েছে মাউন্ট ত্রিশূলের উপর। মাটিতে সূর্য্যের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো এক ঘুমে পৃথিবী বদলে গেছে। বরফের বল বানিয়ে ছোঁড়াছুড়ি, হুটোপুটি চলল। আর সাথে নিরন্তর ছবি তোলা।
সমস্যা হল অন্য জায়গায়। নেগি আমাদের সাথে একটি ছোট মিটিংয়ে বসলেন যে আমরা এগোবো কি না। সত্যি বলতে, আমাদের ইচ্ছেও ছিল। জলদি গেটার পরে নিলাম। গেটার অনেকটা ক্রিকেটের প্যাডের মতো কিন্তু এর অবস্থান হয় ট্রাউসারের ভিতরে। জুতোর গলার সাথে গেটার শক্ত করে বাঁধা থাকে, যার ফলে পা ডুবে গেলেও জুতোর মধ্যে বরফ যাওয়ার ফাঁক থাকেনা। অন্যথায় জুতোর ভিতর বরফ ঢুকে ফ্রস্ট বৈত্ হবার সম্ভাবনা প্রচুর। আমরা তাই লাঠি হাতে গেটার পরে একটু ওঠার চেষ্টা করলাম। এবং অচিরেই বুঝতে পারলাম, এই বরফ দিয়ে হেঁটে ব্রহ্মতাল যাবার অর্থ বিপদ ডেকে আনা। এরই মধ্যে দেখি একটি দল উঁচু পাহাড় থেকে আমাদের দিকে নেমে আসছে। তাঁরা ব্রহ্মতালের একটু আগে তাঁবু খাটিয়ে ছিলেন। এবং সেই ঝড়ের দাপটে সেই তাঁবু ছিড়ে গেছে। এক ভদ্রলোককে কোনওরকমে পিঠে নিয়ে তাঁরা আসছেন। তড়িঘড়ি সেই অসুস্থ ভদ্রলোকটিকে আমাদের তাবুতে স্লিপিং ব্যাগে মুড়ে দেওয়া হল। তাঁর জুতো মজা খুলিয়ে দেখে নিলাম, পায়ে তেমন বরফ লাগেনি। অত্যন্ত অবসন্ন বোধ করছিলেন তিনি। দুধ গরম করে ব্র্যান্ডি মিশিয়ে খাওয়ানো হল। এবং লক্ষ্য রাখা হল তিনি যেন ঘুমিয়ে না পড়েন। ওঁর পক্ষে এখন একটু ঘুমের অর্থই হল চিরনিদ্রা। এর পর দেখি আরও একটি দল নেমে আসছে।
অতয়েব আমরা ঠিক করলাম, এবার ফিরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এবং যত কষ্টই হোক, আজই আমাদের লোহাজং ফিরতে হবে। রাস্তা পুরোটা উৎরাই হলেও বরফের মধ্যে ছয় ঘন্টার পথ পার হতে আট ঘন্টা লাগবেই। অতয়েব তড়িঘড়ি তাঁবু গুটিয়ে নামা শুরু হল।
পিছল পথ। বারবার পরে যাচ্ছি প্রত্যেকেই। লাঠি দিয়ে টাল সামলে, বরফে গড়িয়ে, বাকি পথ কিভাবে যে নামলাম তা এখনো নিজের কাছেই এক বিস্ময়।
বেকাল তালে পৌঁছে দেখি আমাদের সেই ধুলোয় ভরা বুগিয়াল সাদা “ওয়েডিং গাউন” সজ্জিত হয়ে বিদেশিনী নববধূ বেশে সজ্জিত আর তাঁবুগুলি যেন তাঁর গলার রতন হার।
লোহাজং পৌঁছনোর পর দেখি পুরো গ্রামটা বরফের চাদরে ঢাকা। আর শেষ বিকেলের রোদ পড়ে কি মায়াবী লাগছে গোটা গ্রামটাকে। এই কঠিন পথে ট্রেক করে আসার পর রাতে শুনলাম দেশী মুরগির মাংস রান্না হবে। এবং সবাইকে অবাক করে রান্না ঘরে ঢুকল আমাদের বন্ধু দীপান্বিতা। তাকে সাহায্য করল নাসমিন। রাতে ধোঁয়া ওঠা ভাত ও মুর্গীর ঝোল খেয়ে লম্বা ঘুম।
হয়তো সম্পূর্ণ হয়নি, কিন্তু আমাদের ট্রেক সফল। তুষারঝড় প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমাদের মতো সমতলের মানুষের সামনে খুব একটা আসেনা। প্রকৃতি আমাদের সেই সুযোগ দিয়েছেন। তাঁর যে রুদ্র রূপ এবং পরবর্তী স্নিগ্ধতা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, তা আমাদের সবার সবথেকে বড় প্রাপ্তি।
লেখক: ট্রাভেলার, ফটোগ্রাফার